আজ বৃহস্পতিবার, ১৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

দৌড়ে আসে দালালরা

নাদিম হাসান:

শহরের ৩ শ’ শয্যা বিশিষ্ট খানপুর হাসপাতালে বর্তমানে শুধু মাত্র করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। আপাতত এ হাসপাতালে অন্য কোন রোগের চিকিৎসা করা হয় না। বিষয়টি না জেনে এখনও প্রতিদিন অনেক রোগী হাসপাতালে যান চিকিৎসা নিতে। আর তখননি পরতে হয় দালালদের খপ্পরে। গেটের সামনে কাউকে দেখতে পেলেই রোগী ভেবে দৌড়ে আসে দালালরা। দালালদের এ দৌরাত্ম অনেক পুরনো হলেও তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না।

এ বিষয়ে আরেক জন ভোক্তভোগি মুজাহিদ জানায়, আমার মা রোববার দুপুরে অসুস্থ হয়ে পরলে  তাকে নিয়ে এ হাসপাতালে যাই আমি ও আমার বাবা। রিক্সা থেকে নামার পর আমাদের দেখে দুই জন লোক কাছে এসে বলে রোগীর কি হয়েছে ? তখন তাকে বলি যে হঠাৎ দুপুর থেকে মায়ের বুকে ব্যাথা ও শ্বাস কষ্ট দেখা দিলে করোনা হয়েছে এই ভয়ে তাকে খানপুর হাসপাতালে ভর্তি করতে এসছি। একথা শুনে তারা বলল এ রোগী  এখানে ভর্তি করানো যাবে না তাকে প্রাইভেট কোন ক্লিনিকে নিয়ে যান। সাথে সাথে আরেক লোক বলে উঠল এক কাজ করেন তিন হাজার টাকা দেন আমরা ব্যবসস্থা করছি। সুন্দর বেডে ও ভালো ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিব। আমি তার কথায় রাজি না হলে তারা সবাই আমাকে অনেক ভাবে বুঝাতে থাকে। এক পর্যায়ে মাকে নিয়ে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতে যাব তখন আরও কয়েকজন এসে একই কথা বলেছে। তবে তাদের কথায় আমরা কোন সাড়া দেইনি।

ভুক্তভোগী আরিফ যানায়, হাসপাতালে যখন আনা হয় তখন আমার জ্ঞান ছিল না। পরে শুনলাম আমার ভাই এক দালালের সঙ্গে ঔষধের দোকানে গিয়ে অতিরিক্ত দামে ঔষধ কিনে এনেছে।

বন্দর মাহমুদ নগর এলাকার একজন ভুক্তভোগী রানা আহমেদ বলেন, প্রায় তিন চার মাস আগে মামাতো ভাইয়ের পায়ে ইনফেকশন হওয়ায় তাকে খানপুর হাসপাতালে নিয়ে যাই। তারপর ডাক্তার পা দেখে প্রেসক্রিপশনে একটি ইনজেকশন ও কিছু ঔষধ লিখে দেয়। পরে হাসপাতাল থেকে বেরহয়ে রিক্সা নিব এমন সময় সামনে হাজির হন হাসপাতালের লোক পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তি। ঐ ব্যক্তি চিকিৎসকের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র আমার হাত থেকে নিয়ে বলে, আমার সঙ্গে চলেন। কম দামে সব ঔষধ কিনে দেব। তখন কম দামে ঔষদ কিনতে তার সাথে একটি ফার্মেসি তে গেলে সে আমাকে সাতশ আঁশি টাকার ঔষধ কিনে দিয়ে আমার কাছে আরো ৫ শ’ টাকা দাবি করে। কিন্তু আমি অতিরিক্ত আরও পাঁচশ টাকা দিতে রাজি না হলে তিনি উত্তেজিত হয়ে যান এবং বলে কমদামে ঔষদ কিনে দিয়েছি আমার কমিশন দিতে হবে। দুই হাজার টাকার ঔষধ ৭ শ পঞ্চাশ টাকায় পেয়েছেন তাতে মন ভরে নি আমাদের কমিশন দিতে গেলেই আপনাদের সমস্যা হয়। কিছুক্ষন এভাবে কথা কাটা কাটি হলে আরও কয়েক জন লোক আসে এবং আমাকে ধমকাতে থাকে এবং নানা ভাবে হুমকি দেয়। এক পর্যায়ে আমি বাধ্য হয়ে তাকে ৩ শ’ টাকা দিয়ে সেখান থেকে দ্রুত বাসায় চলে আসি।

সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের প্রধান গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে এক সাথে তিন জন নারী ও চার পাঁচ জন পুরুষ মিলে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। কথা শেষ করে তারা আলাদা আলাদা স্থানে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে । এবং এক জন হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে  রোগীদের সাথে কথা বলে তাদের খোজ খবর নিয়ে বাইরে থাকা লোকদের ফোন করে যানায়। পরে রোগীরা গেটের বাইরে এলে বাইরে থাকা দালালরা একজন এক জন করে তাদের সাথে কথা বলে। এবং কৌশলে রোগীর কাছ থেকে চিকিৎসকের দেয়া ব্যবস্থাপত্র সংগ্রহ করে। এরপর কম মূল্যে ঔষধ কিনে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে রোগীর স্বজনদের বিভ্রান্ত করে ফেলে। এতে অনেকেই দালালদের কথা বিশ্বাস করে প্রতারিত হন। তা ছাড়া হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসলেও এই দালালদের খপ্পরে পরে নানা ভাবে হয়রানির শিকার হন অসহায় রোগীরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দালালদের একটি প্রভাবশালি চক্র রয়েছে যাদের মধ্যে নারী পুরুষ মিলিয়ে মোট বিশ থেকে পঁচিশ জন লোক রয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েক জনের নাম পাওয়া গেলেও বাকিদের নাম এখনো পাওয়া যায়নি। তবে দালাল চক্রের অন্যতম সদস্যদের মধ্যে রয়েছে রবিন, চিনু, সোহাগ, দিনা, নাসিমা, রাজিয়া, ফরিদা, বিলকিস, ইবু, আনোয়ার, দিন ইসলাম, খালেক সহ আরো অনেকে। তারা প্রতিদিন সকাল ও বিকেল দুই বেলা এ হাসপাতালের বাইরে ডিউটি করে। প্রত্যেকের স্থান  ভাগ করা।

দালালেরা প্রথমে গেটের বাইরে থেকে রোগীকে অনুসরণ করে ওয়ার্ডে যায়। সাধারণত ওয়ার্ডে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে প্রয়োজনীয় ওষুধের একটি ব্যবস্থাপত্র দেন। দালালদের নজর থাকে ওই ব্যবস্থাপত্রে। এরপর সুযোগ বুঝে রোগীর স্বজনের সাথে ভাব জমান তারা। এরপর নানা কৌশলে দালালেরা ব্যবস্থাপত্র হাতে পেলে নির্দিষ্ট দোকানে নিয়ে যায় রোগীর স্বজনদের। মূলত তারা হাসপাতালে গেটের বাইরে অবস্থিত ওষুধ দোকানগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে দালালি করে। ওষুধের দোকান থেকে প্রতি হাজারে একশ টাকা কমিশন নেয় তারা। অন্যদিকে এ দলের সদস্যদের হাসপাতালে ঢুকতে দেয়ার অনুমতি বাবদ প্রভাবশালী চক্র সপ্তাহে এক থেকে দেড় হাজার টাকা চাঁদা নেয় ঔষধের দোকান থেকে। তবে এসকল দালালদের হাসপাতালের সাথে কোন রকমের যোগসাজশ না থাকলেও তারা নিজেদের হাসপাতালের স্টাফ হিসেবে রোগীদের কাছে পরিচয় দিয়ে থাকে।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক ফার্মেসি মালিক জানায়, প্রতিদিন হাসপাতালের গেটের সামনে দালালরা দাঁড়িয়ে থাকে কোন রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসলে দালালরা নানা ভাবে রোগীদের হেনস্থা করে। অনেক সময় রোগিদের সাথে খারাপ আচরন করে।  বর্তমানে এই দালালের উৎপাত এতটাই বেড়েছে যে রোগীরাও এখানে আসতে ভয় পায়।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক আরেক এ্যাম্বুলেন্স চালক জানান, করোনার মধ্যেও কমেনি দালালদের দৌর-ঝাপ। যেখানে রোগী সেখানেই হাজির হয়ে যায় এরা। মূল ফটক থেকে পুরো হাসপাতাল জুড়ে রয়েছে তাদের অবাধ বিচরণ ও আধিপত্য।

খানপুর হাসপাতালের তত্বাবদায়ক ডা.গৌতম রায় জানান, দালালদের ব্যপারে একেবারেই অবগত নই তা বলব না। এদের কথা আমি শুনেছি তবে এদের আমি চিনি না। এ বিষয়ে আমি আইন শৃঙ্খলা বাহিনির উর্ধতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি অতি দ্রুতই এদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ